সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পতনের মাধ্যমে ২৪ বছরের দীর্ঘ স্বৈরশাসনের ও ১৪ বছরের যুদ্ধের অবসান হলো। একটু পিছনে ফিরে গেলে দেখি ১৯৭০ সালে রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থায় তার বাবা হাফিজ আল আসাদ সামরিক বাহিনী থেকে সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করেন। তখন থেকেই মূলত কর্তৃত্ববাদী শাসন শুরু হয়। ২০০০ সালে তার বাবা মারা যাওয়ার পর বাশার আল আসাদ ক্ষমতা দখল করেন। সিরিয়ার মানুষ ভাবলেন এবার বুঝি তারা স্বৈরশাসন থেকে পরিত্রাণ পাবেন। কিন্তু না, বাশার দিগুণ কর্তৃত্ববাদী শাসক হিসাবে ফিরে আসলেন। সবমিলিয়ে সিরিয়ার মানুষ ৫৪ বছরের আসাদ বংশের কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে মুক্তি পেলো।
যুদ্ধ কাদের মাঝে হলো? পক্ষ কে? বিপক্ষ কে?
এখানে মোটাদাগে চারটি পক্ষ-
১ম পক্ষ - বাশার সরকার পক্ষ। যাকে সহায়তা দিয়েছে রাশিয়া, ইরান ও হিজবুল্লাহ। রাশিয়া সহযোগিতার কারণ তার মিত্র সরকারকে টিকিয়ে রাখা আর ইরান ও ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া গোষ্ঠী সমর্থনের কারণ শিয়াপন্থি সরকারকে টিকিয়ে রাখা ও ISIS কে প্রতিরোধ করা।
২য় পক্ষ -ফ্র সিরিয়ান আর্মি। এরা মূলত বিদ্রোহী সেনা ও বেসামরিক লোক নিয়ে গঠিত। এদেরকে সমর্থন দিয়েছে সৌদি, আমেরিকা, ন্যাটো, তুরষ্ক, কাতার, জর্ডান ও আরবের ধনী দেশগুলো। বিদ্রোহীরা সুন্নি সমর্থিত হওয়ার কারণে মূলত সৌদিসহ আরব রাস্ট্রগুলো সমর্থন দিয়েছে। পশ্চিমারা সমর্থনের কারণ রাশিয়া-ইরানপন্থী সরকারকে হটিয়ে নিজেদের মদদপুষ্ট সরকার প্রতিষ্ঠা। তাছাড়া তৈল ও খনিজ সম্পদতো বোনাস।
৩য় পক্ষ - পৃথিবীতে রাস্ট্রবিহীন সবচেয়ে বড় জাতি হলো কুর্দিরা যারা সিরিয়া, ইরাক, তুরষ্ক ও আর্মিনিয়াতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এই বিশাল অঞ্চল নিয়ে কুর্দিরা মূলত একটি আলাদা রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যাদেরকে সমর্থন করে আমেরিকা। কিন্তু তুরষ্ক এদেরকে দেশদ্রোহী শত্রু মনে করে তাদের উপর হামলা চালায়। কারণ তাদের সাথে তুরষ্কের কুর্দিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে । এজন্য তুরষ্ক ফ্রি সিরিয়ান আর্মিদির সাথে মিলে এদেরকে প্রতিহত করতে চায়। তুরষ্কের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। আর সিরিয়ার সরকার এই সুযোগ নিয়ে কুর্দিদের সহযোগিতা নিয়ে বিদ্রোহিদের মোকাবিলা করার চেষ্টা করতো।
৪র্থ পক্ষ : ISIS এদের কোন মিত্র নেই। সবাই শত্রু। ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশজুড়ে এরা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ধারণা করা হয় বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যেই এরা ইসরাইল, আমেরিকার সৃষ্টি। কিন্তু হয় হিতে বিপরীত। সিরিয়ার সরকার বিদ্রোহীদেরকে দমন করার জন্য সব দাগী কয়েদীদেরকে মুক্তি দেয়। যার ফলে আল-কায়েদা, ISIS এর মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মাথাছাড়া দিয়ে উঠে। আমেরিকা আইএস দমন করার জন্য যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। অপরদিকে ইরানও আইএস দমন করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। অপরদিকে রাশিয়া বাশারের পক্ষ নেয়। এতে বিদ্রোহিরা দুর্বল হয়ে গেলেও নিঃশেষ হয়ে যায় না।
কেন পতন হলো বাশারের??
★ তিউনিসিয়াকে দিয়ে ২০১১ সালে আরব বসন্ত শুরু হয়। আর একটার পর একটা আরব স্বৈরশাসকদের মসনদ ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায। প্রথমে তিউনিসীয়া, তারপর, মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন ও সুদান। সেই আগুনের ঢেউ লাগে বাশারের মসনদে। রাশিয়া আর ইরানের সহযোগিতায় সেবারের মতো ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও এবার আর শেষ রক্ষা হয় নি। বাংলাদেশের সরকারের মতো শেষ পর্যন্ত বিমানে করে পালাতে হয়েছে।
★সিরিয়ার ৮০% মানুষ সুন্নি, ১৪% শিয়া। বাশার মূলত সংখ্যালঘু শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী। যার ফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ক্ষমতার বাহিরে। এরাই মূলত সরকার বিরোধী হিসাবে পরিচিত। সিরিয়ার মানুষ বহুজাতিতে বিভক্ত। এটাও পতনের অন্যতম কারণ।
★ বাশার শুরু থেকেই emergency law দিয়ে দেশের মানুষদেরকে কয়েদী করে রেখেছে। দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি দেশটিকে গ্রাস করে রেখেছে। বেকারত্ব অসম্ভব রকমের বেড়ে গেছে। দীর্ঘদিন যুদ্ধের ফলে দেশটিতে দুর্ভিক্ষ লাগেই আছে। দুই কোটি মানুষ শরণার্থী যাদের অধিকাংশ পার্শবর্তী দেশ তুরষ্ক, লেবানন, জর্ডান ও ইরাকে মানবেতর জীবনযাপন করছে। পাঁচ লক্ষ মানুষ এই যুদ্ধে জীবন দিয়েছে। সর্বত্র মানবাধিকার নেই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। দীর্ঘদিনের অপশাসনের ফলে দেশটির মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।
★ সিরিয়ার মিত্র রাশিয়া ইউক্রেনের সাথে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। অপরদিকে ইরান ইসরাইলের সাথে প্রক্সি যুদ্ধে একরকম ক্লান্ত । হিজবুল্লাহও ইসরাইলের সাথে যুদ্ধ করে একরকম দুর্বল। তাই বিদেশি শক্তিগুলো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, বাশার সরকারও একপ্রকার দুর্বল হয়ে পড়ে।
★ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে বাশার আল আসাদ। পশ্চিমারা সেটা বন্ধ করতে সিরিয়ায় বোমা হামলা চালায়। পুতিনও কম যায় না, বিদ্রোহী ঘাটি লক্ষ করে বোমা ফেলান। তুর্কীরাও উত্তরের কুর্দিদের লক্ষ করে বোমা হামলা চালায়। তুর্কিদের লক্ষ সিরিয়ার কুর্দিদেরকে উৎখাত করে ওখানে শরণার্থীদের জন্য সেফ হোম বানাবে। পুরা সিরিয়া যেন দোযখপুরী। যার ভোক্তভোগী সাধারণ মানুষ।
★ বাশার ক্ষমতায় থাকলেও পুরো সিরিয়া নিয়ন্ত্রণ করতো তিনটা গ্রুপ। উত্তর-পূর্ব অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতো কুর্দিরা, বাশার নিয়ন্ত্রণ করতো সীমান্ত অঞ্চল ও দামেস্ক। বাকী মরুভূমি নিয়ন্ত্রণ করতো আইএস সমর্থিত বিদ্রোহী গোষ্ঠী। বিদ্রোহি সব গ্রুপের লক্ষ ছিলো এক। তা হলো স্বৈরশাসক বাশারকে উৎখাত করা। তাই সিরিয়ার ভবিষ্যৎ সবসময় অনিশ্চিত ছিলো।
কিভাবে সিরিয়া নিয়ন্ত্রণ নিলো?
বিদ্রোহী গত ৩০ নভেম্বর সিরিয়ার ইদলিব শহর দখল করে নেয়। তারপর বিদ্যুৎ গতিতে একে একে আলাপ্প, দামেস্কসহ সব শহর বিনা বাঁধায় গতকাল ৮ই ডিসেম্বর দখল করে নেয়। সারা সিরিয়ার মানুষ বুনো উল্লাসে মেতে উঠেছে। বাশার ও তার বাবার সব ভাস্কর্য ভেঙ্গে পদদলিত করেছে। মনে হয় যেন গত জুলাই -অগাস্টের মতো আরেকটি সফল বিপ্লব।
কে হারলো? কে জিতলো?
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সুন্নি মতাদর্শী HTS( hayat tahiri Al sham সরকার গঠন করবে। বিদ্রোহী সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটির নেতৃত্বে আছে আবু মোহাম্মদ আল জাওলানি। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠার সময় এ গোষ্ঠীটির নাম ছিলো জাবাত আল নুসরা, যা ছিলো সরাসরি আল-কায়েদা জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে সংযুক্ত। তবে এখানে অনেক গোষ্ঠী আছে যাদের সাথে ক্ষমতা ভাগ করতে হবে। তাই ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সমীকরণ অনেক জটিল হবে।
সুন্নিরা সরকার গঠন করবে ধরে নিয়ে সৌদিপন্থীরা হয়তো খুশি, তেহরান হয়তো নারাজ। মস্কো হয়তো হেরে গেছে কিন্তু পশ্চিমারাও জিতছে বলা যাবে না। কারণ বিজয় উল্লাসে সিরিয়ার পতাকার পাশাপাশি ফিলিস্তিনের পতাকা উড়তে দেখা গেছে। তাই কঠিন এক মারপ্যাঁচের সামনে দাঁড়িয়ে সিরিয়া।
কে এই আবু মোহাম্মদ আল জাওলানি?
২০১১১-১২ সালের দিকে IS গঠিত হওয়ার পর তিনি ছিলেন এই সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। তারপর মতের মিল না হওয়ায় তিনি হায়াত তাহিরি আল শাম নামে আরেকটি সংগঠন গড়ে তুলেন। এই গোষ্ঠীটি বিপ্লবের চেয়ে জিহাদি মতাদর্শে বিশ্বাসী। তারা সিরিয়ার খেলাফত কায়েম করতে চায়। মনে রাখা ভালো HTS সংগঠনটিকে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইসরাইল ও তুরস্ক কালো তালিকাভুক্ত করে রেখেছে। দেখা যাক সামনের সমীকরণ কি হয়।
সামনে কী হবে??
যুদ্ধবিধ্বস্ত মৃত্যুপুরী সিরিয়ার সামনে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। অবকাঠামো সব ধ্বংস। অর্থনীতি প্রায় মৃত,বেকারত্ব চরমে, সর্বত্র দুর্ভিক্ষ। কে জিতলো? কে হারলো? কার লাভ? কার ক্ষতি? তার চেয়ে বড় সামনের সিরিয়ার চিত্র কেমন হবে? সিরিয়ার সোনালি যুগ ফিরে আসবেতো?? সিরিয়ার জনগন মুক্ত বিহঙ্গের মতো চলতে পারবেতো? নাকি তাদেরকে আগের মতো খাঁচায় বন্দী জীবন কাটাতে হবে??তা জানতে হলো আমাদেরকে আরোকিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।...চলুন অপেক্ষা করি...
আব্দুল আজিজ মাসুদ
৪৩তম বিসিএস (শিক্ষা)