জীবনযাপনঃ বর্তমান সময়ে যেসব দুরারোগ্য অসুখে ভুগে মানুষ মৃত্যু বরণ করছে এর মধ্যে কিডনিজণিত জটিলতা অন্যতম। এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫ লাখ মানুষ কিডনির অসুখে ভুগে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। কিডিনি বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের দেশের মানুষ কিডনির অসুখ ধরতে খুব দেরি করে ফেলেন। অনেকটা শেষ সময়ে তারা চিকিৎসকের কাছে আসেন, যখন করার আর কিছুই থাকে না।
আপনার কিডনির অসুখ আছে কি নেই তা জানতে নিচের প্রশ্নগুলোর হ্যা অথবা না উত্তর দিন। বেশিরভাগ উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে আর দেরি না করে আজই কিডনি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিডনির অবস্থা পরীক্ষা করিয়ে নিন।
১. সবসময় ক্লান্তি অনুভব করেন?
কিডনি দুর্বল বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে দিয়ে এমনটা দেখা যায়। মাঝে মাঝে ক্লান্তি অনুভব করা ঠিক আছে। কিন্তু সবসময়ই যদি এক ধরণের দুর্বলতা ও ক্লান্তি অনুভ করেন তার মানে আপনার কিডনি সঠিকভাবে কাজ করছে না।
২. শরীর ফুলে গেছে?
হাত-পা অস্বাভাবিক রকম ফুলে যাওয়া কিডনির মারাত্মক রকম অসুখের ইংগিত দেয়। কিডনির অসুখের কারণে রক্তচাপ বেড়ে গেলে শরীরের বিভিন্ন অংশে তরল জমে যায় এবং ফোলাভাব দেখা দেয়।
৩. প্রস্রাবের সমস্যা হচ্ছে?
প্রস্রাবের সমস্যা যেমন প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া হওয়া, প্রস্রাবের রং পরিবর্তন হওয়া ইত্যাদি কিডনি রোগের প্রাথমিক লক্ষণ।
৪. শ্বাস নিতে কষ্ট হয়?
কিডনির অসুখের কারণে শরীরে বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ বেড়ে গেলে ফুসফুসেও বর্জ্য জমে। এতে করে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়।
৫. সবকিছু ভুলে যাচ্ছেন?
কিডনির অসুখের কারণে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ না হলে চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে যায়। কোনো কিছু মনে করতে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খাওয়া কিডনি সমস্যার লক্ষণ।
৬. ভিন্নরকম চুলকানি
কিডনি সমস্যা থাকলে হাড়ের ভেতর চুলকানির মত বোধহয়। শরীরের বর্জ্যপদার্থগুলো জমে থাকার ফলে এ ধরণের অসহ্যকর অনুভ‚তি হয়।
৭. সুস্বাদু খাবারও অখ্যাদ্য লাগে?
কিডনির অসুখের কারণে খাবার থেকে পুষ্টি উপাদান শোষণে সমস্যা হয়। এতে করে খাবার অখাদ্য মনে হতে পারে।
৮. নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ হয়?
কিডনির অসুখের কারণে শরীরে বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ বেড়ে গেলে নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ হয়।
৯. মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়েন?
কিডনির অসুখের কারণে রক্তে শর্করার মাত্রা কমে গেলে মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়তে পারে। তবে, এই লক্ষণটি কিডনি রোগের খুবই গুরুতর লক্ষণ। এই লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন।
১০. পস্রাবের সমস্যা হচ্ছে?
কিডনির অসুখের কারণে পস্রাবের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া হওয়া, প্রস্রাবের রং পরিবর্তন হওয়া।
একটু সচেতন থাকলেই আমরা এসব দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোড প্রতিরোধ করতে পারি।
এক. অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ কিডনি বিকল করে। পরিবারে যাদের বয়স ৪০ পেরিয়েছে, তারা নিয়মিত রক্তচাপ মাপুন, বেশি থাকলে ওষুধ গ্রহণ করুন। পাতে লবণ একেবারেই নিষেধ। ‘রক্তচাপ একটু বেশি থাকলে কিছু হয় না বা সমস্যা না হলে ওষুধ খাবার দরকার নেই’ এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন। বয়স্করা অনেক সময় ওষুধ খেতে ভুলে যান, বা রক্তচাপ বাড়লেও বুঝতে পারেন না। তাদের দিকে বিশেষ নজর দিন।
দুই. বাংলাদেশে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস কিডনি বিকল হওয়ার প্রধানতম কারণ। রক্তে শর্করা কাক্সিক্ষত মাত্রার নিচে রাখতেই হবে। নিয়মিত রক্তের শর্করা মাপুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যাদের ডায়াবেটিস আছে, তারা বছরে অন্তত এক বা দুবার কিডনি পরীক্ষা করাবেন। মনে রাখবেন, ডায়াবেটিস যে কারো হতে পারে। যে কোনো বয়সে যে কোনো সময় হতে পারে।
তিন. স্থুলতার সঙ্গেও কিডনি রোগের সম্পর্ক আছে। এ বছরের (২০১৭) কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্যই ছিল অধিক ওজন ও কিডনি রোগ। দেখা গেছে কিডনিতে পাথর, ক্যানসার ও দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগের সঙ্গে স্থুলতা জড়িত। এ ছাড়া ওজন বাড়লে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ঝুঁকিও বাড়ে। তাই নিয়মিত ব্যায়াম করুন। ওজন কমান। এতে অন্যান্য রোগের মতো কিডনি রোগের ঝুঁকিও কমবে।
চার. যখন-তখন ইচ্ছে হলেই দোকান থেকে কিনে ওষুধ খাবেন না। অনেক ওষুধ আছে যা কিডনির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অনেক ওষুধ মাত্রাতিরিক্ত হলে কিডনির সমস্যা হতে পারে। বনাজি, হারবাল ওষুধ, অতিরিক্ত ভিটামিন ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্টও ক্ষতিকর হতে পারে। শিশুদের যেকোনো ওষুধে খুবই সাবধানতা জরুরি। মাত্রার একটু এদিক-ওদিক হতে পারে কিডনি রোগ প্রতিরোধের উপায়বিরাট বিপত্তি। তাই সাবধান, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ কখনো নয়।
পাঁচ. ধূমপান কিডনিতে রক্ত চলাচল ব্যহত করে। এ ছাড়া কিডনি ক্যানসারেরও ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপান একেবারেই বর্জন করুন। শিশুর ও নারীরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। সবার সুরক্ষার জন্যই ধূমপান ছাড়াটা জরুরি।
ছয়. পরিবারে সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। প্রচুর শাক-সবজি, ফলমূল খেতে হবে। লাল মাংস কম খান। পানি বেশি খেলে কিডনি ভালো থাকবে এমন কোনো কথা নেই। তবে আবহাওয়া অনুযায়ী যথেষ্ট পানি পান করুন। শিশুরা স্কুলে ঠিকমতো পানি পান করে কি না খেয়াল করুন। প্রস্রাব আটকে রাখা খারাপ। প্রস্রাবে সংক্রমণ এড়াতে ব্যক্তিগত ও টয়লেটের পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দিন।
সাত. বয়স বাড়লে, বিশেষত উক্ত রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থাকলে, প্রতিবছর নিয়ম করে কিডনির সুস্থতা জানতে প্রস্রাবে আমিষ ও প্রয়োজনে অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান। কোনো ব্যতিক্রম লক্ষ্য করলে সতর্ক হোন। ছোটদেরও কিডনিতে প্রদাহ হয়। প্রস্রাব কম হওয়া, লাল হওয়া ও শরীরে পানি জমা এর লক্ষণ। এমন হলে চিকিৎসা নিতে দেরি করবেন না।