সারাবিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১৪ কোটি ১০ লক্ষ ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান করা হয়, এর ৩৮ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে। ক্যান্সার, থ্যালাসেমিয়া কিংবা অন্যান্য রক্ত সংক্রান্ত যে কোন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে স্বেচ্ছায় রক্তদানের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ‘২ নভেম্বর’ জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ৬ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হলেও এর মাত্র ২৫% আসে স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতাদের মাঝ থেকে। ৫০% রিপ্লেসমেন্ট ডোনার বা আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে এবং বাকি ২৫% পেশাজীবি রক্তদাতাদের কাছ থেকে সংগৃহীত হয়।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক বাণী দিয়েছেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ ও সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির উদ্যোগে দিবসটি দেশব্যাপী পালিত হবে।
রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব দূরীকরণে স্বেচ্ছায় রক্তদানের পাশাপাশি মরণোত্তর চক্ষুদানে সকলকে উৎসাহিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
তিনি বলেন, দেশে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ কর্নিয়াজনিত সমস্যার কারণে অন্ধত্ববরণ করছে। কিশোর- কিশোরী এবং কর্মক্ষম ব্যক্তিবর্গ এই কর্নিয়াজনিত কারণে অন্ধ হচ্ছেন। এই বিপুল সংখ্যক অন্ধ ব্যক্তির চিকিৎসায় পরিবার ও রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো এই বিপুল সংখ্যক অন্ধ মানুষের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়া। আর কর্নিয়াজনিত অন্ধত্বের ক্ষেত্রে মানব কর্নিয়া প্রতিস্থাপনই একমাত্র চিকিৎসা। তাই কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব দূরীকরণে স্বেচ্ছায় রক্তদানের পাশাপাশি মরণোত্তর চক্ষুদানে সকলকে উৎসাহিত করতে হবে।
এ বছর রক্তদান কর্মসূচি উৎযাপন সম্পর্কিত এক বাণীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও সর্বস্তরের জনগণকে স্বেচ্ছায় রক্তদানের মত মানবিক কর্মসূচিতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন স্বেচ্ছায় রক্তদানকে উদ্ভুদ্ধ করতে তার সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিরাপদ রক্তের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৭২ সালে বিএসএমএমইউ তে রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ চালু করেন। তিনি এবারের রক্তদান দিবস উৎযাপন সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান আন্দোলনের পথিকৃৎ ‘সন্ধানী’। রক্তদানের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি মানুষের চক্ষু ব্যাংক হিসেবেও কাজ করে থাকে। মৃত্যুর আগে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত চক্ষুদানের বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করে থাকে সন্ধানী, যাতে ভবিষ্যতে কেউ ব্যবহার করতে পারেন সেই চোখ।
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৮-৯ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয় আর সংগৃহীত হয় ৬-৬ দশমিক ৫ লাখ ব্যাগ রক্ত। বছরে প্রায় তিন লাখ ব্যাগ রক্তের ঘাটতি থাকে। সংগৃহীত রক্তের ৩০-৩৫ শতাংশ আসে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের থেকে।
আমাদের দেশে এখন প্রায় ১৪ লাখ মানুষ অন্ধত্ব বরণ করে আছে এবং বছরে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ কর্নিয়াজনিত দৃষ্টি সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব দূর করতে আগামী ১০ বছরে প্রতি বছরে ৩৬ হাজার কর্নিয়া সংগ্রহ করা প্রয়োজন, যা মৃতের মাত্র ২ শতাংশ।
মরণোত্তর চক্ষুদানঃ মারা যাওয়ার পর মৃত ব্যক্তির কর্নিয়া ৬ ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করতে হবে। কোথাও কোথাও ১২-২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। ৬ ঘণ্টার মধ্যে কর্নিয়া সংগ্রহ না করলে কর্নিয়া সেলের সংখ্যা কমে যায়। কর্নিয়া হলো চোখের সামনের স্বচ্ছ অংশ, যার মাধ্যমে আলো চোখের মধ্যে প্রবেশ করে। কোনো কারণে কর্নিয়ায় ঘা হলে বা কর্নিয়া অস্বচ্ছ হয়ে গেলে ওই চোখে আলো প্রবেশ করতে পারে না।
নষ্ট হয়ে যায় ওই চোখের দৃষ্টিশক্তি। এ অবস্থাকে বলা হয় কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব। চোখ হলো একজন মানুষের সর্বোচ্চ আশীর্বাদ এবং শ্রেষ্ঠ উপহার। দৃষ্টিশক্তি হারানো ব্যক্তি কর্মক্ষমতা হারিয়ে পরিবার তথা সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। চক্ষুদান ক্ষুদ্র মানবজীবনকে করে তোলে তাৎপর্যপূর্ণ। মৃত্যুর পরও অনন্তকালের সৌন্দর্য উপভোগ করা, আরেকটা জগৎ আলোকিত করে তোলার মহৎ ক্ষমতা রয়েছে চক্ষুদানের। এতে কোনো কাটাকাটি নেই।
রক্তপাত বা চেহারা বিকৃতির কোনো আশঙ্কাও নেই। তারপরও মৃত ব্যক্তির কর্নিয়ার স্থানে সিনসেটিক একটা পর্দা লাগিয়ে দেওয়া হয়, যাতে কোনো অবস্থাতেই বোঝা সম্ভব না হয় যে, চোখের পর্দা দান করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই সম্পন্ন করা হয়। চক্ষুদান প্রক্রিয়াটি হয় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। চক্ষুদাতা এবং চক্ষু গ্রহীতার সঙ্গে কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেন হয় না।
জীবিত অবস্থায় প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ নারী-পুরুষ মরণোত্তর চক্ষুদানে অঙ্গীকার করতে পারেন। পরিচিত মানুষের চক্ষুদানের বিষয়টি আগে থেকেই অবগত করে রাখতে হবে, যাতে দাতার মৃত্যুর পর তাদের মধ্যে দায়িত্বশীল কেউ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি সম্পর্কে দ্রুত অবগত করতে পারেন।
অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ব্যবিদ্য়ালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে প্রথমে আমি আমেরিকান আই ডোনেশন সোসাইটির সহায়তায় একটি আই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করি। মরণোত্তর চক্ষুদান সমিতি ও জাতীয় চক্ষু ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর প্রথমে যে চক্ষুটি সংগ্রহ করা হয়, সেই চক্ষুটি সংগ্রহ করার বিরল সুযোগটিও আমি পেয়েছিলাম।
প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালের ১০ জুন জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম দেশের স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচিতে প্রথম রক্তদান করেন। তারপর ১৯৭৮ সাল থেকে স্বেচ্ছায় রক্তদানকে উৎসাহিত করতে প্রতিবছর ২ নভেম্বর এ দিবস পালন করা হয়।
রক্তদান সম্পর্কিত কিছু তথ্যঃ
★আমরা রক্তদান করবো কেন?
১. এর প্রথম ও প্রধান কারণ আপনার/আমার দানকৃত রক্ত আরেকজন মানুষের জীবন বাঁচাবে, এর থেকে মহৎ আর পরিতৃপ্তিকর কী হতে পারে?
২. হয়তো আপনার নিজের/পরিবারের এমন বিপদের মুহূর্তে অন্য কেউ এগিয়ে আসবে। কারণ আল্লাহ সকল কাজের পুরস্কার একইভাবে দিয়ে থাকেন।
৩. নিয়মিত রক্তদানের মাধ্যমে জানা যায় শরীরে এইচআইভি(এইডস), সিফিলিস, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, ম্যালেরিয়ার মত বড় কোন রোগের সংক্রমণ আছে কি না।
৪. নিয়মিত রক্তদানে হৃদরোগ ও হার্ট এ্যাটাকের ঝুঁকি কমে।
৫. ধর্মীয় দিক বিবেচনা করলে রক্তদান অতি পূণ্যের কাজ। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে, ‘কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করলো’ (সূরা আল মায়িদা, আয়াত ৩২)
★রক্তদানের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গ?
১. ৪৫ কিলোগ্রাম বা তার বেশী ওজনের ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী শারিরীক ও মানসিকভাবে সুস্থ্য যে কোন ব্যক্তি রক্তদানের উপযোগী।
২. রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমান ৭৫% বা তার উপরে থাকলে, রক্তচাপ ও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকলে, সম্প্রতি ৬ মাস কোন দূর্ঘটনা বা বড় ধরনের কোন অপারেশন না হলে ৩/৪ মাস পরপর রক্ত দান করা যায়।
৩. শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত রোগ, যেমন- অ্যাজমা, হাঁপানি; কিংবা অন্যান্য রোগ যেমন- এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া, হেপাটাইটিস, ম্যালেরিয়া, ক্যান্সার, যক্ষা বা হৃদরোগ থাকলে রক্ত দান করা যাবে না। তবে, টাইফয়েড আক্রান্ত রোগী রক্ত দিতে পারে।
৪. অ্যান্টিবায়োটিক সেবনকালে, মহিলাদের গর্ভাবস্থায় বা মাসিক চলাকালীন সময়ে রক্তদান না করাই শ্রেয়।
★রক্তদানে যে সুবিধা বিদ্যমানঃ
১. প্রতি চারমাস অন্তর রক্ত দিলে দেহে নতুন ব্লাড সেল তৈরীর প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
২. নিয়মিত রক্তদানকারীর হার্ট ও লিভার অন্যদের তুলনায় ভালো থাকে।
৩.রক্তদান অনেক ক্ষেত্রে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়, রক্তে কোলেস্টেরলের উপস্থিতি কমাতে সহায়তা করে।
৪. নিয়মিত রক্ত দানে শরীরে অতিরিক্ত আয়রনের উপস্থিতি (হিমোক্রোমাটোসিস) প্রতিরোধ করা যায়।
৫. রক্তদান স্থুলদেহী মানুষের ওজন কমাতে সহায়ক।
★রক্তদান পূর্ববর্তী সময় কি করণীয়ঃ
১. রক্তদাতা কোন কারণে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সেদিনের মত রক্তদান থেকে বিরত থাকা উচিত।
২. রক্তদানের পূর্বে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। বেশি পরিমাণ পানি বা পানি জাতীয় খাবার (ডাবের পানি, জুস, স্যালাইন) খেতে হবে। তবে তৈলাক্ত খাবার, চর্বিযুক্ত খাবার খেলে ব্লাড টেস্ট প্রভাবিত হতে পারে।
৩. রক্ত দেওয়ার আগের রাতে ডোনারের পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানো উচিত।
৪. প্লেটলেট ডোনারের ক্ষেত্রে দুইদিন আগে থেকে অ্যাসপিরিন গ্রহণ বন্ধ করতে হবে।
৫. যতদূর সম্ভব রক্তদানের আগে ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করা উচিত।
★রক্তদান পরবর্তী সময় কি করণীয়ঃ
১. রক্তদানের পর বেশ কিছুটা সময় শুয়ে থাকতে হবে। হুট করে দাঁড়ানো বা বসা উচিত নয়।
২. পরিমান মত পানি/ পানি জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে এবং পরবর্তী ২৪ ঘন্টা অ্যালকোহল গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
৩. রক্তদানের পর ভারী কোন কাজ বা ব্যায়াম না করাই ভালো।
পুরো রক্ত দান প্রক্রিয়ায় খুব বেশি সময় লাগে না। এই অল্প সময়ে আরেকজন মানুষের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা যায়। তাই আসুন আমরা নিজে রক্ত দিই, অন্যকে দিতে উৎসাহিত করি।