এরই মধ্যেই ১১৪ বছরের প্রথা ভেঙে চলতি শিক্ষাবর্ষে পঞ্চম, ষষ্ঠ ও নবম শ্রেণিতে এই প্রথমবারের মতো ছয়জন হিন্দু শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। স্কুলের প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, ১৪ ডিসেম্বর ভর্তি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে সোমবার (১১ ডিসেম্বর) সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ আকতার সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক যেকোনো ধর্মের যে কোনো শিক্ষার্থী যদি আমাদের বিদ্যালয়ে লটারির মাধ্যমে চান্স পায়, আমরা সেই শিক্ষার্থীকে ভর্তি নিচ্ছি। ইতিমধ্যে আমরা ছয় জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করেছি। ১৪ তারিখ পর্যন্ত বিদ্যালয়ের ভর্তি চলবে। আমার কাছে ধর্ম কোনো বিষয় না। আমার বিষয় হচ্ছে লটারিতে পাশ করেছে তাদের ভর্তি করতে হবে, যারা মেধাতে এসেছে তারা ভর্তি হবে।’
বিষয়টি নিয়ে সরগরম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর আগে থেকেই। এদের কেউ মুসলিম হাই স্কুলে ভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থী ভর্তির বিপক্ষে, কেউবা আবার পক্ষে। তবে স্কুলটির সাবেক শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ এমন সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছেন। এমন সিদ্ধান্তকে নির্বাচন ঘিরে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার ‘কুটচাল’ বলে মনে করছেন তারা। তাদের অভিযোগের তীর শিক্ষাখাতের সঙ্গে যুক্ত চট্টগ্রামের এক শীর্ষ রাজনৈতিক নেতার দিকে। ভোটের আগে আগে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যে অনেকে আবার হিন্দু ভোটারদের কৌশলে কাছে টানার ‘চালাকি’ও দেখছেন।
এদিকে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ‘সম্মিলিত অভিভাবক ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে ‘ভর্তি লটারিতে অমুসলিম ছাত্রদের অন্তর্ভুক্ত না করার অনুরোধ’ জানিয়ে ব্যানার সাঁটানো হয়েছে মুসলিম হাই স্কুলের মূল ফটকের সামনে। পরে অবশ্য সেই ব্যানার আর দেখা যায়নি।
সরকারি মুসলিম হাই স্কুল চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানা সংলগ্ন একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। দানবীর হাজী মুহাম্মদ মহসিনের আর্থিক অবদানে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম গভর্ণমেন্ট মাদ্রাসার অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগ হিসেবে ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১০টি ভবন নিয়ে স্কুলটিতে পঞ্চম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। বর্তমানে এর ছাত্রসংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি।
এদিকে ১১৪ বছর ঐতিহ্য ভেঙে মুসলিম হাই স্কুলে ভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থী ভর্তির ঘটনাকে স্বাগত জানিয়ে কেউ কেউ বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মের ভেদাভেদ কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে সবার সমান অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা দরকার।
তারা বলছেন, চট্টগ্রামের মুসলিম হাই স্কুল নামে মুসলিম হলেও এটা ধর্মীয় কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, অথবা ধর্মীয় কারিকুলামভিত্তিক মাদ্রাসাও নয়। যেহেতু এটি একটি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তাই সেখানে মুসলিমদের সাথে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পাহাড়ি-বাঙালি প্রত্যেক বাঙলাদেশি শিক্ষার্থীরও পড়ার অধিকার আছে।
আবার বিপক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে কেউ কেউ ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ নিয়ে বলছেন, ১১৪ বছরের ইতিহাসে ইসলাম ধর্মের নানা রীতি মেনে মুসলিম হাইস্কুলে পাঠদান চলছে। যে প্রতিষ্ঠানের জন্মই মুসলিম ছাত্রদের জন্য, সেখানে অন্য ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থী কেন আসবে? মুসলিম হাই স্কুলের বাচ্চাদের মাথায় টুপি থাকে, এর মানে একটা ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে প্রত্যেকটা ছাত্র বা ছাত্ররা থাকে। সেখানে অন্য ধর্মের বাচ্চারা ভর্তি হলে কিভাবে অ্যাডজাস্ট করবে?
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘লটারির মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে লটারিতে যারা পাস করবে, এখানে কোনো ধর্মবিভেদের বিষয় নেই বা ধর্ম বৈষম্যের বিষয় নেই। যারাই লটারিতে পাস করবে এবং মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হবে তারাই ভর্তি হবে সেখানে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিপরীতে আমি কথা বলতে পারবো না৷’
বিংশশতাব্দীর প্রথম দশকে তৎকালীন দানবীর হাজি মুহাম্মাদ মহসীন তার সম্পদ থেকে মহসিন তহবিল গঠন করার উদ্যোগ নেন। শুরুতে তিনি একটি দাতব্য তহবিল এবং পরবর্তীতে মহসিন তহবিল নামে একটি তহবিল গঠন করেন। এই তহবিলের অর্থ শিশুদের শিক্ষাখাতে ব্যয় করার নির্দেশ দেন। উপমহাদেশে মুসলিম শিক্ষার প্রসার ঘটায় চট্টগ্রাম মহসীনিয়া মাদ্রাসা নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। পরবর্তীতে মহসীনিয়া মাদ্রাসা পরিবর্তিত হয়ে মহসিন উচ্চ বিদ্যালয় এবং গভর্নমেন্ট মহসিন কলেজ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানে পরণিত হয়। ইতোমধ্যে মুসলিম ছাত্রদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মুসলিম নেতাদের অধীনে এবং মহসিন মাদ্রাসার প্রধান তত্ত্বাবধানে ইঙ্গ-ফার্সি বিভাগ চালু করা হয়। ১৯০৯ সালে ওই মাদ্রাসা বিভাগ থেকে বিদ্যালয়টি স্থানান্তর করা হয়।
স্কুলটির সাবেক ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন বার্মার শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রী সুলতান মাহমুদ, বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সদ্য পদত্যাগী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার সুলতান আহমেদ চৌধুরী, সঙ্গীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুসহ আরো অনেকে।