চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ,জ্বলছে না চুলা, চলছে না গাড়ি
Date: 2023-10-22
ইফতেখার উদ্দিন : গ্যাসের সংকটের কারণে গতকাল শনিবার ও আজ রোববার নগরের অনেক এলাকার মানুষ খাবারের জন্য হোটেলে লাইন দিয়েছেন। অনেকের বাড়িতে রান্নার মাঝপথে গ্যাস চলে গেছে। বিকল্প হিসেবে রাইসকুকার, ইন্ডাকশন কুকার ও স্টোভ ব্যবহার করেছেন অনেক গ্রাহক। চট্টগ্রামে আবার গ্যাস সংকট শুরু হয়েছে। মহেশখালী থেকে এলএনজি সরবরাহ এক তৃতীয়াংশ কমে যাওয়ায় চট্টগ্রামের শিল্প, বিদ্যুৎ, বাসা–বাড়ি ও সিএনজি স্টেশনে গ্যাস সরবরাহে ধস নামে। পরে বিশেষ রেশনিং ব্যবস্থায় রান্নাঘরের চুলা জ্বালানোর ব্যবস্থা করা হয়। গ্যাস সংকট বেশ কয়েকদিন থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। চট্টগ্রামে গ্যাসের সংকট পুরনো। চট্টগ্রামের গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে এখানে কম–বেশি সমস্যা ছিল। কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলের গ্যাস আসা বন্ধ করার পর চট্টগ্রাম বর্তমানে পুরোপুরি আমদানিকৃত এলএনজিনির্ভর। বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি কমে গেলে বা কোনো কারণে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ হলে চট্টগ্রামে গ্যাসের সংকট হয়। পাইপলাইন ব্যবহার করে বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের জন্য ২৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রেখে বাকিটা পাঠানো হয় ঢাকা অঞ্চলে। কিন্তু গতকাল হঠাৎ করে গ্যাসের এই প্রবাহে ধস নামে। মহেশখালীর এলএনজি টার্মিনালে থাকা দুটি এলএনজিবাহী জাহাজের (এফএসআরইউ) একটিতে রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিছু যান্ত্রিক সমস্যা সমাধানে বিশেষ এই মেরামত কার্যক্রম শুরু করায় এলএনজি সরবরাহ কমে গেছে। প্রতিদিন এখান থেকে ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হলেও গত দুদিন ধরে তা নেমে আসে ৫শ মিলিয়ন ঘনফুটের কমে। এতে করে চট্টগ্রামের জন্য বরাদ্দকৃত ২৭০ মিলিয়ন ঘনফুটের স্থলে গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয় ২৩০ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের প্রবাহ কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ে রান্নাঘর থেকে শুরু করে সর্বত্র। গতকাল সকাল থেকে বিভিন্ন এলাকায় চুলা বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় নগরজুড়ে গ্যাসের হাহাকার তৈরি হয়। বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই ভোগান্তিতে পড়েন। সিএনজি স্টেশনসহ গ্যাসনির্ভর নানা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে চট্টগ্রামের বেশিরভাগ পোষাক কারখানা শুক্রবার বিকেলের পর থেকে বন্ধ। যেসব প্রতিষ্ঠানের ইমার্জেন্সি শিপমেন্ট আছে সেগুলো নিজ উদ্যোগে বিকল্প জ্বালানি দিয়ে কোনভাবে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে কারখানা মালিকরা। গ্যাস না থাকায় খাবার হোটেলে দীর্ঘ লাইন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে স্বামী-সন্তানের জন্য খাবার তৈরি করতে যান চট্টগ্রামের জামাল খান এলাকার বাসিন্দা নুসরাত জামাল। কিন্তু চুলা জ্বালাতে গিয়ে দেখেন লাইনে গ্যাস নেই। স্বামীর অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে- তড়িঘড়ি করে বাসা থেকে বের হয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনতে যান নুসরাত। কিন্তু জামালখান এলাকার কয়েকটি খাবার হোটেল ঘুরে এসেও খাবার পান নি। কারণ গ্যাস সংকটের কারণে হোটেলগুলোতেও রান্না হয় নি। পরে বাসায় থাকা শুকনা খাবার (কলা, মুড়ি, বিস্কুট) দিয়ে সকালের নাস্তা সারে পুরো পরিবার। নগরীর কাজীর দেউড়ি এলাকার খোয়াজা রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'ফজরের নামাজের পর থেকে খাবারের খোঁজে আসছে মানুষ। কিন্তু গ্যাস লাইনে গ্যাস না থাকায় হোটেলে রান্না সম্ভব হয় নি। মানুষের ছুটাছুটি দেখে আমরা এখন সিলিন্ডার সরবরাহ করে রান্না করছি। তবে প্রতিদিন যে পরিমাণ রান্না হয়, গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে সে পরিমাণ সম্ভব নয়।' একই এলাকায় ক্যাফে লায়লার সামনে দেখা যায় মানুষের দীর্ঘ লাইন। লাইনে দাঁড়ানো খালেদ কায়সার (পরিদর্শক, পুলিশ) নামের একজন বলেন, 'সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময় স্ত্রী বলেন, চুলায় গ্যাস নেই। তখন তাড়াতাড়ি করে মোড়ের হোটেলে চলে আসি। কিন্তু এখানে দেখি, হোটেল থেকে খাবার কিনতে মানুষের বিশাল লাইন। এদিকে অফিস টাইমও দেরি হয়ে যাচ্ছে।'
'সকালে ঘুম থেকে উঠে চুলা জ্বালিয়ে দেখি গ্যাস নেই। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। আমার ৩ বছর বয়সী বাচ্চার জন্য খাবার তৈরি করতে হবে। ওকে কী খাওয়াব বুঝতে পারছি না,' বলছিলেন চট্টগ্রামের আসকার দীঘির পাড় এলাকার বসিন্দা পারভিন আক্তার।
পরিবহন সংকটে পায়ে হেঁটে অফিসে ছুটছে মানুষ এদিকে গ্যাস সংকট প্রকট হওয়ায় চট্টগ্রাম নগরীতে যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ডিজেল চালিত পরিবহনগুলো চললেও তা যাত্রীর তুলনায় খুবই কম। গণপরিবহন না পেয়ে সকাল থেকে রিক্সা কিংবা পায়ে হেঁটে ছুটছে্ন অফিসগামী নারী-পুরুষ। চকবাজার এলাকায় রিক্সার জন্য অপেক্ষমান একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আনিস চৌধুরী বলেন, 'গাড়ি খুঁজতে খুঁজতে পায়ে হেটে রাহাত্তারপুল থেকে চকবাজার গুলজার মোড়ে (দেড় কিলোমিটার) চলে এসেছি। যেতে হবে অলংকার মোড়। স্বাভাবিক সময়ে রাহাত্তারপুল থেকে অলংকার যেতে সর্বোচ্চ ২০ টাকা ভাড়া লাগলেও এখন রিক্সায় যেতে ভাড়া হাঁকাচ্ছে ১০০ টাকা।' এদিকে ডিজেল চালিত পরিবহন চলাচল করলেও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নগরীর লালখান বাজার এলাকায় লেগুনা (টেম্পু) ড্রাইভারের সাথে ভাড়া নিয়ে কথা-কাটাকাটি চলছিল এক যাত্রীর। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে মো. ইয়াসিন নামের সে যাত্রীর অভিযোগ, 'বারেক বিল্ডিং থেকে লালখান বাজারে লেগুনার ভাড়া ১০ টাকা। কিন্তু এখন ২০ টাকা নিচ্ছে এই চালক।' ক্ষমতা প্রায় ২১০০ টন। কিন্তু গ্যাস সংকটরে কারণে গতকাল শুক্রবার থেকে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাস নিয়ে সংকট শুরুর পর কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড পরামর্শ করে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) সাথে। কর্ণফুলী গ্যাসের পক্ষ থেকে কাফকো ও সিইউএফএলসহ বড় ইউনিটগুলোতে সরবরাহ কিছুটা কমিয়ে আবাসন খাতে গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার তাগাদা দেওয়া হয়। এরপর সমন্বয় ও রেশনিং করার ফলে বিকাল তিনটা থেকে আবাসন ও সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনসহ বাল্ক খাতে গ্যাসের প্রবাহ কিছুটা বাড়ে। রান্নাঘরের চুলা জ্বলার পর মানুষের ভোগান্তি কমে আসে। কর্ণফুলী গ্যাসের শীর্ষ এক কর্মকর্তা মানুষের ভোগান্তির কথা স্বীকার করে বলেন, এলএনজি প্রবাহ কমে যাওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে। আরো কয়েকদিন এই সংকট থাকবে। আগামী ২৮ অক্টোবর এফএসআরইউর (ফ্লোটিং সিস্টেম রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট) মেরামত কাজ সম্পন্ন হবে বলে তিনি জানান।