২০২২ সালে সবার প্রথমে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে শ্রীলঙ্কার সরকার। ওই ঘটনার কিছু দিনের মধ্যেই প্রায় একই পরিস্থিতি হয় নেপালের।
কোথাও এক টুকরো রুটির আকাশছোঁয়া দাম! কোথাও আবার পেট্রল কিনতে নাভিশ্বাস উঠছে আমজনতার। শুধু তা-ই নয়, দেউলিয়া হওয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে শতাধিক দেশ। বিশ্ব অর্থনীতির এ হেন ‘করুণ’ দশা দেখে ভুরু কুঁচকেছেন তাবড় আর্থিক বিশ্লেষকেরাও।
রাষ্ট্রপুঞ্জের উন্নয়ন কর্মসূচি বিভাগের প্রধান আচিম স্টেইনারের দাবি, যে কোনও দিন কোষাগার শূন্য হতে পারে দুনিয়ার অন্তত ৫০টি রাষ্ট্রের। বিশ্ব ব্যাঙ্ক আবার এই তালিকায় রেখেছে ১০৪টি দেশের নাম। এর মধ্যে অধিকাংশ আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া হলেও সরু সুতোর উপর ঝুলছে বেশ কয়েকটি উন্নত দেশও।
এখন প্রশ্ন হল, কখন কোনও রাষ্ট্রকে দেউলিয়া বলে ঘোষণা করা হয়? আর্থিক বিশ্লেষকদের কথায়, দু’টি পরিস্থিতি তৈরি হলে এটা বলা যেতে পারে। কোনও দেশের বৈদেশিক অর্থভান্ডার ফুরিয়ে গেলে তার কপালে জোটে দেউলিয়ার তকমা। দ্বিতীয়ত, এই রাষ্ট্রগুলির নিজস্ব কোষাগারে থাকে না একটা টাকাও।
দ্য রিল গডফাদার : ভারতের এ মাফিয়া ডন তরুণদের মাঝে কেন এতো জনপ্রিয়?
দেশ দেউলিয়া হলে সাধারণত প্রথমেই সেখানে দেখা দেয় জ্বালানি এবং খাদ্যসঙ্কট। ডলারের নিরিখে হু-হু করে অনেকটা নীচে নেমে যায় স্থানীয় মুদ্রায় দর। ফলে খাবার বা পেট্রপণ্যের জন্য রাস্তায় নেমে আসে জনতা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয় লুটপাট। শুধু তা-ই নয়, এই পরিস্থিতিকে গৃহযুদ্ধের আকার নিতেও দেখা গিয়েছে।
শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি সাম্প্রতিক অতীতে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া পেরু বা আর্জেন্টিনার ভয়ঙ্কর ছবি প্রত্যক্ষ করেছে গোটা বিশ্ব। দক্ষিণ আমেরিকার এই দুই দেশে খাবার ও জ্বালানির জন্য সাধারণ মানুষকে হিংসায় জড়িয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে, যা থামাতে গুলি পর্যন্ত চালাতে হয়েছে সেখানকার সেনা বা পুলিশকে। দেউলিয়া রাষ্ট্রের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক ঋণের জালে জড়িয়ে থাকে এই সমস্ত দেশ। উদাহরণ হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকা বা পাকিস্তানের কথা বলা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলির জিডিপির হার হয় ঋণাত্মক। গত ৩০ বছরে প্রথম বার আর্থিক বৃদ্ধির সূচকে যে ছবি কেনিয়ায় দেখা গিয়েছে।
কিন্তু কেন হঠাৎ আর্থিক ভাবে ডুবতে বসেছে দুনিয়ার এতগুলি দেশ? এর নেপথ্যে মূলত চারটি কারণের কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদেরা। প্রথমত, গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব জুড়ে খাদ্যসঙ্কট বাড়তে শুরু করেছে। এর জন্য জলবায়ু পরিবর্তন এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করেছেন তাঁরা।
আর্থিক বিশ্লেষকদের কথায়, জলবায়ু পরিবর্তন কৃষির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ফলে বিশ্বের নানা প্রান্তে মার খেয়েছে ফসল উৎপাদন। এর জেরে গত দু’বছর ধরেই ধীরে ধীরে খাদ্যদ্রব্যের দাম ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার বাজারে চড়তে শুরু করেছে। সেই কারণেই দেউলিয়া হওয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা দেশগুলির অর্থনীতি ফোঁপরা করে গিয়েছে।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান (স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) চালাচ্ছে রাশিয়া। এত দিন পর্যন্ত এই দু’টি দেশই দুনিয়া জুড়ে বিপুল পরিমাণে গম রফতানি করে আসছিল। এর মধ্যে ‘ইউরোপের রুটির ঝুড়ি’ হিসাবে ইউক্রেনের পরিচিতি রয়েছে। যুদ্ধ বাধায় গমের রফতানি বন্ধ রেখেছে পূর্ব ইউরোপের এই দুই দেশ।
২০২০ সালে করোনা অতিমারির কবলে পড়ে দুনিয়া। ওই সময় থেকেই খনিজ তেল সরবরাহের শৃঙ্খলে ভাঙন ধরেছিল। আর্থিক বিশ্লেষকদের কথায়, পেট্রপণ্যের চাহিদা কখনওই কোনও দেশে কমে যায় না, উল্টে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বাড়তে থাকে। ফলে এর সরবরাহ ঠিক না থাকলে বেশি অর্থ ব্যয় করে তা কিনতে শুরু করে সরকার।
বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের দেউলিয়া হতে চলা দেশগুলির তালিকায় নাম নেই ভারতের। তবে এখানকার অধিকাংশ রাজ্যের ঋণের অঙ্ক দ্রুত গতিতে বাড়ছে, যা নয়াদিল্লিকে দেউলিয়া হওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে। বর্তমানে মহারাষ্ট্র এবং গুজরাত ছাড়া কোনও রাজ্যের ঋণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রকের চিন্তা বেড়েছে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর।