ইফতেখার উদ্দিন : চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নব নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল আগামী ২৮ই অক্টোবর ২০২৩ উদ্বোধন করা হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থেকে এ মেগা প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন বলে কথা রয়েছে। টানেল উদ্বোধনকে ঘিরে চলছে নানা প্রস্তুতিও। তৈরি করা হচ্ছে উদ্বোধনী নামফলক। টানেলের দুই প্রান্তে সাজ সাজ রব। ১০,৩৭৪.৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম এ সুড়ঙ্গপথ নির্মিত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক হারুনুর রশীদ সাহেব সাংবাদিকদেরকে বলেন, ‘যানবাহন চলাচলের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত মূল টানেল। আগামী ২৮ অক্টোবর এটির উদ্বোধনের কথা রয়েছে। এখন টানেলের ভেতরে-বাইরে নিরাপত্তার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। টানেলের সুরক্ষার জন্য দুই পাশে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ ফাঁড়ির ভবন নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ চলছে। টানেল প্রকল্পের অগ্রগতি ৯৯ শতাংশ। ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘টানেলে নিরাপত্তায় ১০০টির বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। টানেলে চলাচলকারী গাড়ির গতিবেগ ১ম দিকে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের বেশি হবে না। পায়ে হেঁটে টানেল পার হওয়া যাবে না। একইভাবে মোটরসাইকেল এবং তিন চাকার যানবাহনও চলাচল করবে না টানেল দিয়ে। নির্ধারিত ওজনের বেশি ভারী যানবাহন এ টানেল দিয়ে চলতে দেওয়া হবে না। এজন্য টানেলের প্রবেশমুখে নির্মাণ করা হয়েছে ওয়েট স্কেল। পরিমাপের পর বেশি হলে ওই যানবাহনকে পার হতে দেওয়া হবে না। কোন যানবাহন থেকে কী ধরনের টোল নেওয়া হবে তা ইতোমধ্যে নির্ধারণ করে ফেলেছে মন্ত্রণালয়।’
সম্প্রতি সরেজমিন পতেঙ্গা টানেল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে টানেল। প্রবেশ পথে নৌবাহিনীর সদস্যদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। টানেল নির্মাণে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যতীত অন্য কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। পতেঙ্গা থেকে টানেলের প্রবেশমুখ পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে উদ্বোধনী ফলক। যেটি উন্মোচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুল প্রতীক্ষিত টানেলটি উদ্বোধন করবেন। এছাড়া টানেল এলাকাকে সাজানো হচ্ছে মনোরমভাবে। টানেলে দুটি মুখ রয়েছে। এর মধ্যে একটি পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় অপরটি আনোয়ারা প্রান্তে। দুই প্রান্তে দূর থেকে একনজর দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের ভিড় জমে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্পটি পরিদর্শন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব। তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আগামী ২৮ই অক্টোবর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই দিন পতেঙ্গা প্রান্তে টানেল এর উদ্বোধন করা হলেও আনোয়ারা প্রান্তে হবে সুধী সমাবেশ। এতে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য রাখবেন।”
মুখ্য সচিব আরও বলেন, ‘এ টানেল শুধু দুই পাড়কে সংযুক্ত করেনি, ওয়ান সিটি টু টাউন কনসেপ্ট তা বাস্তবায়িত হয়েছে। তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটারের টানেলটি তিন মিনিট থেকে সাড়ে তিন মিনিটের মধ্যে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পার হওয়া যাবে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার নিচে এ টানেল দিয়ে মানুষ চলাচল করবে। এটার সঙ্গে কক্সবাজারের যোগাযোগ অনেক সহজ হবে।’
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক এমডি আবদুল মালেক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘টানেল এর ভেতর অত্যাধুনিক ফায়ার সিস্টেম রয়েছে। পুরো টানেল মনিটরিংয়ের জন্য একটি কন্ট্রোল রুম রয়েছে। সেখান থেকে টানেলের ভেতর কী হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করা হবে। টানেলের ভেতর অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে তা কন্ট্রোল রুম থেকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ আছে। বেশি হলে তখন ফোর্স নিয়ে ভেতরে যেতে হবে। কোনও যানবাহন দুর্ঘটনার কবলে পড়লে কীভাবে সেটি উদ্ধার করা হবে এসব বিষয় নিয়ে আমাদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আগামী ২ অক্টোবর টানেলে চূড়ান্ত মহড়া অনুষ্ঠিত হবে। আমরা কীভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণ করবো এবং কীভাবে দুর্ঘটনাকবলিত যানবাহন উদ্ধারে সহযোগিতা করবো তা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।’
ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘টানেল প্রকল্পের দুই পাড়ে দুটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন হচ্ছে। স্টেশনের ভবন নির্মাণের কাজ চলমান। প্রথম শ্রেণির ফায়ার স্টেশন হলে কর্মকর্তা-সদস্য মিলে ৩৫ জন থাকবে। দ্বিতীয় শ্রেণির হলে থাকবে ২২ জন। তবে এখানে প্রথম শ্রেণির ফায়ার সার্ভিস স্টেশন হওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি।’
এদিকে টানেলের এক প্রান্তে (পতেঙ্গা) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) এরিয়া এবং অপর প্রান্ত (আনোয়ারা) জেলা পুলিশের সীমান্ত। সে অনুযায়ী টানেলের অর্ধেক সিএমপির এবং অর্ধেক জেলা পুলিশের অধীনে। সিএমপি এবং জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে দুই পাড়ে থানা প্রয়োজন। তবে টানেল কর্তৃপক্ষ পুলিশ ফাঁড়ির জন্য ভবন নির্মাণ করছে।
এ প্রসঙ্গে সিএমপির এডিসি (পিআর) স্পিনা রানি প্রামাণিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘টানেল সুরক্ষা দিতে দুই পাড়ে দুটি থানা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দফতরে এ প্রসঙ্গে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। পতেঙ্গা প্রান্তে প্রস্তাবিত থানাটির জন্য ৮১ জন জনবল চাওয়া হয়েছে। সদর দফতর কত জনবলের অনুমোদন দেয় তা দেখার বিষয়। কবে থেকে এ থানার কার্যক্রম শুরু হবে তা অনুমোদন পাওয়ার পর জানা যাবে।
৩০০কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হচ্ছে স্ক্যানার মেশিন :
’টানেলের প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, টানেলের নির্মাণকাজের প্রথম পর্যায়ে দুই প্রান্তে স্ক্যানার মেশিন স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল না। মেয়াদের শেষ মুহূর্তে এসে নিরাপত্তাজনিত কারণে টানেলের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্তে স্ক্যানার মেশিন স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়, যাতে টানেলে প্রবেশের আগেই গাড়িগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। দুই প্রান্তে দুটি করে মোট চারটি স্ক্যানার মেশিন স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই চারটি স্ক্যানার মেশিনের জন্য ব্যয় হবে ৩০০ কোটি টাকা।
প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী গতকাল বুধবার সাংবাদিককে বলেন, টানেল চালুর আগেই দুটি স্ক্যানার মেশিন বসানোর কাজ শেষ হয়ে যাবে। বাকি দুটি স্ক্যানার মেশিন আগামী মাসে দেশে আসবে। এরপর দ্রুত সময়ের মধ্যে তা স্থাপন করা হবে।
সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, স্থাপন করা স্ক্যানার মেশিনগুলো টানেলের ভেতর দিয়ে যাওয়া পণ্যবাহী ভারী গাড়িগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। চালক ও পণ্য রাখার অংশ আলাদা রঙের রশ্মি দিয়ে পরীক্ষা করা হবে। একেকটি গাড়ি স্ক্যানিং করতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ দুই মিনিট। প্রতিটি স্ক্যানার প্রায় ৫০ মিটার লম্বা এবং প্রশস্ততা ১০ মিটার। এগুলোর একেকটির ওজন ১৩ টন। এসব স্ক্যানার মেশিন আনা হচ্ছে ইংল্যান্ড থেকে।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন (ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট) অনুযায়ী, টানেল চালুর প্রথম বছর থেকে দৈনিক গড়ে ১৭ হাজার ৩৭৪টি গাড়ি চলাচল করবে টানেলের ভেতর দিয়ে। তন্মধ্যে ভারী গাড়ি থাকবে ৩ হাজার ২১৮টি। এরপর প্রতিবছরেই এর পরিমাণ বাড়বে।
এদিকে পণ্যবাহী পরিবহনগুলো স্ক্যানার মেশিন দিয়ে পরীক্ষা করা হলেও টানেলের ভেতর দিয়ে যাওয়া কার, মাইক্রোবাস, বাসসহ এ ধরনের পরিবহনের জন্য আলাদাভাবে পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। স্ক্যানারের বিপরিতে ব্যবহার করা হবে ইউভিএসএস (আন্ডারভেহিকেল স্ক্যানিং সিস্টেম)। ইউভিএসএস দিয়ে ট্রাক, বাস, মাইক্রোবাস, কারসহ যানবাহনের নিচের অংশে ছবি তুলে বিস্ফোরকজাতীয় সরঞ্জাম আছে কি না, তা যাচাই করা যায়।
১৯ অক্টোবর ২০২৩