আসাদের যাত্রা শুরু হয়েছিলো তার বড় ভাই বাসেলের গাড়ী দূর্ঘটনায় মৃত্যুর পর। ১৯৯৪ সালে দামেস্কের কাছে ওই দূর্ঘটনা যখন ঘটে আসাদ তখন লন্ডনে চক্ষু চিকিৎসা নিয়ে পড়ছিলেন। বাসেলের মৃত্যুর পর আসাদকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা শুরু হয়।
তৎক্ষণাৎ তাকে ফিরে যেতে হয় সিরিয়ায় এবং এরপর তাকে সিরিয়ার পরবর্তী নেতা হিসেবে প্রস্তুত করার কাজ শুরু হয়। বাশার সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন এবং ভবিষ্যতের জন্য জনগণের সামনে নিজের ইমেজ তৈরির প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর ২০০০ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে দ্রুতই প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হন বাশারআল-আসাদ। তবে, এজন্য দেশটির সংবিধানে প্রেসিডেন্টের সর্বনিন্ম বয়স ৪০ বছর থাকার যে বিধান ছিলো তা পরিবর্তন করতে হয়। দায়িত্ব নিয়ে তিনি ‘স্বচ্ছতা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, আধুনিকায়ন, জবাবদিহিতা ও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবনা’র কথা বলেছিলেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার কয়েক মাস পর তিনি আসমা আল-আখরাসকে বিয়ে করেন। তাদের তিন সন্তান- হাফিজ, জেইন এবং কারিম।
প্রথমদিকে তার রাজনৈতিক সংস্কার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ক বক্তব্য অনেককে আশাবাদী করেছিল। তার নেতৃত্বের স্টাইল ও পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত আসমার সাথে জুটিবদ্ধ হওয়া- অনেককে স্বপ্ন দেখিয়েছিলো। কিন্তু ২০০১ সালে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক দমন অভিযান চালায় ও বহু সোচ্চার কণ্ঠকে আটক করে। তবে আর শাসনের প্রথম দিকে উত্থান হয় তার চাচাতো ভাই রামি মাখলৌফের। তিনি সম্পদ আর ক্ষমতার সমন্বয়ে বিশাল ব্যবসা সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন।
২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধকে ঘিরে বাশার আল-আসাদের সাথে পশ্চিমাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। তিনি ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছিলেন। সম্ভবত তার আশংকা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর পরবর্তী টার্গেট সিরিয়া হতে পারে।
বাশার আল-আসাদের শাসনের প্রথম দশকে ইরান, কাতার এবং তুরস্কের সাথে সম্পর্কের উন্নতি হয়। সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। যদিও শুরুতে রিয়াদ তরুণ প্রেসিডেন্টের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলো।
২০১১ সালের মার্চে দামেস্কে বিক্ষোভ দেখা যায় এবং পরে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর দারারাতে দেয়ালে আসাদ বিরোধী শ্লোগান লেখার দায়ে শিশুদের আটক করা হলে সেখানেও আন্দোলন শুরু হয়। দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করে আসাদ পার্লামেন্টে দেয়া ভাষণে সিরিয়াকে টার্গেট করে ‘ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে বলে একে মোকাবেলার কথা বলেছিলেন। এরপর নিরাপত্তা বাহিনী দারারাতে শক্তি প্রয়োগ করলে বিক্ষোভ আরও জোরদার হয়। সংঘাত বেড়ে যাওয়ার পর জাতিসংঘের হিসেবে লাখ লাখ মানুষ হতাহত হয়েছে। একই সাথে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোও জড়িয়ে পড়তে শুরু করে। রাশিয়া, ইরান এবং ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো আসাদের বাহিনীকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, তুরস্কসহ কিছু উপসাগরীয় দেশ সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেয়।
২০১৫ সালে প্রায় পতনের দ্বারপ্রান্তে চলে যায় আসাদ সরকার। দেশের বড় অংশের ওপরই তখন বাশার আল-আসাদে আর কর্তৃত্ব ছিলো না। তবে, পরে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ পরিস্থিতি পাল্টে যায়, গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো আবার পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন বাশার আল-আসাদ।
২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাস ইসরায়েলে হামলা করলে গাজা যুদ্ধের সূচনা হয় যা লেবাননেও ছড়িয়ে পড়ে। যার প্রভাব পড়ে আসাদের সহযোগী হেজবুল্লাহর ওপর। হেজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহও নিহত হন। লেবাননে যেদিন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয় সেদিনই বিস্ময়করভাবে হামলা করে দ্রুত আলেপ্পো দখল করে নেয় হায়াত তাহরির আল-শাম বা এইচটিএস এর নেতৃত্বে সিরিয়ার বিরোধী গোষ্ঠী। তারা দ্রুত গতিতে এগিয়ে হামা ও অন্য শহরগুলো দখল করে নেয়। দক্ষিণাঞ্চলে তখনো সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছিলো।
কিন্তু আসাদের অবস্থান দ্রুতই নড়বড়ে হয়ে পড়ে, কারণ গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ইরান ও রাশিয়া তার সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীরা দামেস্ক ঢুকে পড়েছে এবং বাশার আল-আসাদ ব্যক্তিগত বিমানে করে অজানা গন্তব্যে চলে গেছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন এর মাধ্যমেই অবসান হলো সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসন।